*﷽ ﷽ ﷽ ﷽ ﷽* *﷽*
*ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস*
*🥀====দ্বিতীয় অধ্যায়,পর্ব -১ ====🥀*
*হযরত মুআবিয়ার রাযি.কীর্তিগাঁথা শাসনামল*
হযরত মুআবিয়ার রাযি. খিলাফতকালে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মুসলিম উম্মাহর শক্তি ও গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। হযরত উসমানের রাযি. শাহাদাতের পর মুনাফিক সাবায়ীদের প্রচেষ্টায় মুসলমানদের দুঃখজনক পারস্পরিক হানাহানিতে মুসলিম শাসনের দিগ্বিজয়ের যে ধারা দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ ছিল, হযরত মুআবিয়াহ রাযি. খলীফা নির্বাচিত হয়ে কাফির শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও মুসলিম জাহানের সীমান্ত সম্প্রসারণের সেই ধারা আবার পুরোদমে উজ্জীবিত করেন। তাঁর শাসনামলেই মধ্য এশিয়ার সিজিস্তান, সুদান, কাবুল ও সিন্ধুর অংশ বিশেষ বিজিত হয়। পঁয়তাল্লিশ হিজরীতে আফ্রিকা অভিযান পরিচালনা করে তিনি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ইসলামী খিলাফতের মানচিত্রে সংযোজন করেন। এছাড়া সিসিলি অভিযান এবং কনস্টান্টিনোপল ও সকরকন্দ যুদ্ধ তাঁর আমলেই সংঘটিত হয়। তাঁর খিলাফতকালেই হিন্দুস্তানের ভূখণ্ডে এবং আমু দরিয়া অতিক্রম করে বুখারায় সর্বপ্রথম মুসলিম ফৌজ প্রবেশ করে। মুসলিম ফৌজের এই অব্যাহত বিজয় যাত্রা কাফিরদের শিবিরে নতুন করে ত্রাস সৃষ্টি করে।
হযরত উসমানের রাযি. খিলাফতকালে সিরিয়ার গভর্নর থাকাবস্থায় তিনি হযরত উসমানের রাযি. অনুমতিতে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য বিশ্বের প্রথম নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ২৭ হিজরীতে ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নৌবহর যোগে সাইপ্রাস অভিযান পরিচালনা করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নিম্নোক্ত সুসংবাদের অধিকারী হনঃ
“আমার উম্মতের যে প্রথম সৈন্যদলটি নৌ অভিযানে অংশ নিবে, তারা নিজেদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।” এ অভিযানে সাহাবীগণের রাযি. এক মুবারক জামা’আত তাঁর সাথে ছিলেন।
খিলাফত লাভের পর নৌশক্তির উন্নয়নের প্রতি তিনি বিশেষ মনোযোগ নিবিষ্ট করেন। ফলে মিসর ও সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে অসংখ্য জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে অল্প কয়েক বছরে এক হাজার সাতশ’ বৃহদায়তন ও মজবুত জাহাজের সমন্বয়ে গড়ে উঠে এক বিরাট নৌবহর যা রোমদের মুকাবিলায় থাকত সদা প্রস্তুত। এ বিরাট নৌবহরের সাহায্যেই স্বীয় খিলাফত আমলে (হিজরী ৪৯ সনে) তিনি সুফিয়ান বিন আওফের পরিচালনায় কনস্টান্টিনোপলের পথে এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করেন। বহুসংখ্যক বিশিষ্ট সাহাবী রাযি. তাতে শরীক ছিলেন। এ বাহিনী সম্পর্কেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছিলেন-
“মুসলমানদের প্রথম যে বাহিনী কনস্টান্টিনোপলের জিহাদে যাবে, তাদের জন্য মহান আল্লাহর মাগফিরাত নির্ধারিত।”
হযরত উমরের রাযি. আমলে প্রতিষ্ঠিত ডাক বিভাগ পুনর্বিন্যাস, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে হযরত মুআবিয়া রাযি. উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। বিশাল ইসলামী খিলাফতের সর্বত্র তিনি ডাক বিভাগের জাল বিছিয়ে দেন। এছাড়া সিল মোহর বিভাগ নামে নতুন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাইতুল্লাহ শরীফের খিদমতের জন্য তিনি স্থায়ী সেবক নিযুক্ত করেছিলেন এবং আল্লাহর ঘরের জন্য মূল্যবান রেশমী কাপড়ের গিলাফ তৈরী করেছিলেন।
সুদীর্ঘ একচল্লিশ বছর তিনি খিলাফতের বিভিন্ন দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছিলেন। এ সুদীর্ঘ শাসনকালের সামগ্রিক পর্যালোচনা শেষে ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে কাছীর রহ. মন্তব্য করে বলেন, “তাঁর শাসনামলে জিহাদের ধারা অব্যাহত ছিল। আল্লাহর দীন অপ্রতিহত গতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে চলছিল এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গনীমতলব্ধ সম্পদের ঢল নেমে এসেছিল। মোটকথা, তাঁর শাসন ছায়ায় মুসলিম জনসাধারণ সুখ-শান্তি এবং ইনসাফ ও সমৃদ্ধপূর্ণ জীবন-যাপন করছিল।”
জনসাধারণের মনোরঞ্জন, অধিকার ও প্রাপ্য আদায়, ইনসাফ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শরী‘আতের বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। আর তাই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ সাহাবার অন্যতম বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সা’আদ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযি. হযরত মুআবিয়ার রাযি. বাড়ীর দিকে ইঙ্গিত করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় বলেছেনঃ ‘‘হযরত উসমানের রাযি. পর এই ঘরের বাসিন্দার (মুআবিয়ার) চেয়ে অধিক ইনসাফকারী কাউকে আমি দেখিনি।”
হযরত আবু ইসহাক রহ. বলেনঃ হযরত মুআবিয়ার রাযি. শাসনকাল যদি দেখতে, তাহলে ন্যায় ও ইনসাফের কারণে নিঃসন্দেহে তাকে তোমরা ‘মাহদী’ নামে আখ্যায়িত করতে। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক হযরত মুজাহিদ রহ. ও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।
ইমাম আ’মাশের রহ. মজলিসে একবার হযরত উমর বিন আব্দুল আযীযের রহ. ন্যায়পরায়ণতার আলোচনা শুরু হলে, তিনি বলেনঃ তোমরা উমর বিন আব্দুল আযীযের রহ. প্রশংসা করছো, হযরত মুআবিয়ার রাযি. শাসন যুগ দেখলে কি করতে? লোকে জিজ্ঞেস করল- আপনি কি তাঁর সহনশীলতার কথা বলছেন? তিনি বললেন- না, তাঁর ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের কথাই বলছি।
হযরত মুআবিয়ার রাযি. ধৈর্য্য ও সহনশীলতা ছিল প্রবাদ তুল্য। এ দু'টো গুণ ছিল তাঁর জীবন ও চরিত্রে অবিচ্ছেদ্য অংশ। চরম বিরুদ্ধাচারণকারীও তার কোন কোন কথার সরাসরি প্রতিবাদ করতো, অশালীন ভাষা ব্যবহার করতো, কিন্তু তা তিনি সহ্য করে নিতেন। বিশিষ্ট মুরুব্বী সাহাবী হযরত জাবির রাযি. বলেনঃ মুআবিয়ার চেয়ে সহনশীল ব্যক্তি আমি আর দেখিনি। হযরত মুআবিয়ার রাযি. নিজেও বলতেনঃ ক্রোধ হজম করায় যে স্বাদ আমি পাই, তা অন্য কিছুতে পাই না।
কিন্তু এ সহনশীলতা ছিল ততক্ষণ, যতক্ষণ প্রতিপক্ষ শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করত। নীতি ও আইনের প্রশ্নে সামান্যতম নমনীয়তা ছিল না তাঁর চরিত্রে। কোথাও কঠোরতার প্রয়োজন হলে দৃঢ়তার সাথে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
হযরত মুআবিয়ার রাযি. ধৈর্য্য ও ক্ষমা সুন্দর চরিত্রের অসংখ্য ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। ইবনে আওন বলেনঃ হযরত মুআবিয়ার রাযি. আমলে একজন সাধারণ মানুষও তাঁর পথ রোধ করে বলত- মুআবিয়া আমাদের সাথে তোমার আচরণ দুরস্ত করে নাও। নইলে কিন্তু আমরাই তোমাকে দুরস্ত করে ছাড়ব, হযরত মুআবিয়াহ রাযি. বলতেন- ভাই! কি দিয়ে দুরস্ত করবে শুনি? তারা বলত- হাতের এই লাঠি দিয়ে। মুআবিয়া রাযি. বলতেন- আচ্ছা তাহলে এমনিতেই আমি দুরস্ত হয়ে যাচ্ছি।
খলীফা হযরত মুআবিয়া রাযি. প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে কুরসী পেতে বসে যেতেন। এ সময় সর্বস্তরের জনসাধারণ বিভিন্ন নালিশ-অভিযোগ এবং অভাব ও প্রয়োজন নিয়ে হাজিত হত। একে একে সবার কথা তিনি মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং যথাসাধ্য তাদের সন্তুষ্ট করতে ও অভাব-অভিযোগ পূরণের ব্যবস্থা করতেন। এভাবে সর্বশেষ ফরিয়াদী বিদায় হওয়া পর্যন্ত তিনি বসে থাকতেন। অতঃপর নেতৃস্থানীয়দের সাক্ষাৎকার দিতেন এবং তাদের বলতেন- “আপনারা স্ব-স্ব গোত্রের ও এলাকার নেতৃস্থানীয় হওয়ার সুবাদের এই বিশেষ মজলিসে উপস্থিত হতে পেরেছেন। সুতরাং এখানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ যারা পায় না, সেসব সাধারণ জনগণের অভাব-অভিযোগ ও তাদের কথা আমার কাছে তুলে ধরা আপনাদের পবিত্র দায়িত্ব।”
এভাবে দিনের পাঁচটি সময় তিনি নির্ধারণ করে রেখেছিলেন সাধারণ লোকদের জন্য সর্বস্তরের জনসাধারণের জন্য সেখানে সাক্ষাৎ ও অভিযোগ উত্থাপনের অবাধ অনুমতি ছিল। সবাই সেখানে আমীরুল মুমিনীনের দরবারে নালিশ দাখিল করতে পারতেন।
হযরত মুআবিয়ার রাযি. বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অমায়িক চরিত্র, অতুলনীয় অবদান ও অনুপম শাসনামলের তুলনাহীন ও বৈচিত্র্যময় সকল দিকের যতটুকু বিবরণ আরবী ভাষার রচিত মুসলিম ঐতিহাসিকগণের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়, তার বঙ্গানুবাদের জন্য বিশাল কলেবরের গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন।
বস্তুতঃ সকল বিচারেই হযরত মুআবিয়ার রাযি. শাসনকাল খিলাফতে রাশিদা পরবর্তী ইসলামী ইতিহাসের সফলতম ও স্বর্ণযুগ সমস্ত উম্মাহর ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে ছিল পর্যাপ্ত সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা, সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি। জনসাধারণের জীবনযাত্রা, চরিত্র ও নৈতিকতার উপর তাঁর ছিল সদা সতর্ক দৃষ্টি।
_*📋নিজে পড়বেন এবং শেয়ার করে অন্যদেরকেও জানার সুযোগ করে দিবেন।*_
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন