*ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস*
*====== প্রথম অধ্যায়,পর্ব -১৮ ======*
*কল্পিত ইতিহাসের গোড়ার কথা*
এ স্থানে এসে কতিপয় ঐতিহাসিক মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিরোধানের পর ৫/৭ জন সাহাবী রাযি. ব্যতিরেকে অবশিষ্ট সকল সাহাবীর রাযি. মুরতাদ হয়ে যাওয়ার জঘন্য আক্বীদায় বিশ্বাসী শিয়াদের মিথ্যা ও জাল বর্ণনার উপর ভিত্তি করে সালিশী চুক্তি ও পরবর্তী ঘটনা এরূপে লিখেছেন যে নির্ধারিত সময়ে যখন সাহাবীদ্বয়ের রাযি. সালিশী বৈঠক আরম্ভ হয় তখন উভয় সালিশ হযরত আলী ও মুআবিয়া রাযি. উভয়কেই বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তে একমত হন। অতঃপর হযরত আমর ইবনুল ‘আস রাযি. চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে হযরত আবু মুসা আশআরী রাযি. কে প্রথমে তাঁর সিদ্ধান্ত জনসমক্ষে ঘোষণার আহ্বান জানান। চুক্তি অনুযায়ী তিনি স্বাভাবিক ভাবে উভয়কেই খলীফার পদ হতে বরখাস্ত বলে ঘোষণা করেন। আর আমর ইবনুল ‘আস রাযি. বললেন- বরখাস্ত করছি কিন্তু মুআবিয়া রাযি. কে খলীফা হিসেবে বহাল রাখছি। মিথ্যা রচনাকারী শিয়ারা অতঃপর এ বিশিষ্ট দুই বুযুর্গ সাহাবীর রাযি. মধ্যে এমন অশ্লীল বাক্য বিনিময়ের কল্পিত বর্ণনাও দিয়েছে যা একদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী রাযি. চরিত্রের সাথে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয় এবং অপর দিকে তা মেনে নেয়া শুধু ঐ সকল পাপিষ্ঠ দুরাচারীদের পক্ষেই সম্ভব যারা সাহাবীগণের রাযি. সমালোচনার ব্যাপারে মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট সতর্কবাণী উপেক্ষা করে তাদের দোষ চর্চা ও দোষ রচনায় লিপ্ত হয়।
হযরত আমর ইবনুল আসে রাযি. বিশ্বাসঘাতকতা ও চাতুরীর ঘটনা যে শুধুই কল্পিত ও মিথ্যা তা সামান্য চিন্তা করলেই অনুমতি হয়। কেননা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে হযরত মুআবিয়া রাযি. এ পর্যন্ত কখনোই খিলাফতের দাবীই করেননি এবং তাকে খলীফা হিসেবে মানার জন্য তাঁর সমর্থকদের নিকট হতে তিনি কোনরূপ বাইআতও গ্রহণ করেননি। বরং তিনি শুধু হযরত উসমানের রাযি. নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণে তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীদার ছিলেন। সে হিসেবে তিনি তার কিসাসের দাবীতে যুদ্ধ করে ‘আসছিলেন এবং বরাবর হযরত আলী রাযি. কেও এ কথাই বলে ‘আসছিলেন যে, আপনি হযরত উসমানের রাযি. হত্যাকারীদের বিচার করুন। আমি আপনাকে খলীফা মেনে নিয়ে আপনার হাতে বাই’আত হচ্ছি। তাছাড়া যখন সর্বপ্রথম এ কথার উপর সালিশী চুক্তি হয়েছিল যে, উভয় সালিশ ঐক্যমতের ভিত্তিতে কুরআন অনুযায়ী যে ফয়সালা করবেন- তা উভয় পক্ষ মেনে নিবেন, তখন হযরত আমর ইবনুল আসের রাযি. এ কথিত মিথ্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে তাঁর কি লাভ হবে? কেননা- তাদের বর্ণনা অনুযায়ী তো হযরত আলী রাযি. কে বরখাস্ত করে হযরত মুআবিয়া রাযি. কে খলীফা বানানোর তথাকথিত ঘোষণা তার একক সিদ্ধান্ত ছিল, উভয়ের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ছিল না। কাজেই তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুতরাং এ ধরনের অর্থহীন কাজ হযরত আমর ইবনুল ‘আস রাযি.- এর মত বিচক্ষণ সাহাবীর রাযি. পক্ষ থেকে কল্পনাও করা যায় না। তাই সেই কল্পকথা অপবাদমূলক ও মিথ্যাচার স্বার্থ প্রণোদিত।
মূলতঃ সন্ধি চুক্তির পরবর্তী ঘটনার এরূপ বিবরণ সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক ইমাম ইবনে জারীর ত্বাবারী তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারীখে ত্বাবারী’ তে উল্লেখ করেন। অতঃপর তাঁরই অনুসরণে অপরাপর ইতিহাসবিদগণ তাঁদের রচিত ইতিহাসগ্রন্থ সমূহে উক্ত কিতাবের রেফারেন্স দিয়ে কোনরূপ মন্তব্য ছাড়াই এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। এভাবে সংশ্লিষ্ট ঘটনার এ মিথ্যা ও জাল বিবরণটি জগদ্বিখ্যাত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এ অন্যায়ের দোষ ইমাম ইবনে জারীর ত্বাবারীর উপর বর্তাবে না। কারণ, তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি স্পষ্টতঃ বলে দিয়েছেন যে, সব কথার সত্যতা ও শুদ্ধতা যাচাই করে আমি এ গ্রন্থ রচনা করিনি, বরং যার নিকট যেরূপ বর্ণনা পেয়েছি- তাই উল্লেখ করেছি। তবে সুধীবৃন্দের জন্য প্রতিটি ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের সুবিধার্থে বর্ণনার তথ্যসূত্র তথা বর্ণনাকারীদের নাম- পরিচয় উল্লেখ করে দিয়েছি। যাদের বিস্তারিত জীবনালেখ্য ‘আসমাউর রিজাল বিষয়ক গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে। পাঠকবৃন্দ ‘আসমাউর রিজাল গ্রন্থের মাধ্যমে বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে ঘটনার সত্যতার বা জাল হওয়া নির্ণয় করবেন।
তারীখে ত্বাবারীতে এ ঘটনা বর্ণনাকারী হিসেবে কুখ্যাত আবু-মিখনাফের নাম পরিলক্ষিত হয়। ‘আসমাউর রিজালের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করলে তার নামে ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলীর ব্যাপারে অসংখ্য মিথ্যা ও জাল বর্ণনা তৈরীর অভিযোগ পাওয়া যায়। সকল মুহাদ্দিসীনের বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে, সে ছিল কট্টর শিয়া। যারা আব্দুল্লাহ্ বিন সাবার সাবায়ী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি জঘন্য বাতিল পন্থী দল ছিল। দীন ও ইসলাম সম্পর্কে যাদের জঘন্যতম বিশ্বাস সমূহের মধ্যে একটি বিশ্বাস এও ছিল যে, মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিরোধানের পর পাঁচ বা সাত জন সাহাবা রাযি. ব্যতীত সকল সাহাবীই রাযি. কাফির ও মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। (নাউযুবিল্লাহ) এ কারণে তারা বুযুর্গ সাহাবীদের রাযি. প্রতি উম্মতের আস্থা বিনষ্টের ষড়যন্ত্র হিসেবে তাঁদের নামে নানা ধরনের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে জাল ঘটনা তৈরী করে। হযরত আলী ও হযরত মুআবিয়ার রাযি. মধ্যে সিফফীনের যুদ্ধের পরে যে সন্ধি চুক্তি হয়, তার দুই সালিশদ্বয় হযরত আমর ইবনুল ‘আস ও হযরত আবু মুসা আশ’আরীর রাযি. ব্যাপারে মিথ্যাবাদী আবু মিখনাফের রচিত বর্ণনা সে সকল জাল বর্ণনারই অন্তর্ভুক্ত। (তথ্যসূত্র: আল্-‘আওয়াসিম-মিনাল ক্বাওয়াসিম, পৃঃ ১৭৪-১৭৯’)
এদিকে হযরত আলী ও হযরত মুআবিয়ার রাযি. সালিশী চুক্তির পর নতুন করে আবার সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় সাবায়ীরা নিজেদের প্রমাদ গোনে। তাই তারা এ সালিশী চুক্তির বিরোধিতা করে এ বিপক্ষে অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে সে সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে সচেষ্ট হয়। অথচ সিফফীনের যুদ্ধে হযরত আলীর রাযি. নিশ্চিত বিজয়কে বানচাল করার জন্য তারাই হযরত আলী রাযি. কে চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল।
জঙ্গে সিফফীনের পর হযরত আলীর রাযি. পক্ষ থেকে সালিশী চুক্তি সম্পাদনের ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল সাবায়ী এ বলে বিরোধিতা আরম্ভ করে যে, আল্লাহ্র ফয়সালা ব্যতীত কোন মানুষ তথা সালিশের ফয়সালা মানা ইসলাম বিরোধী ও কুফরী কাজ। এই বলে তারা হযরত আলীর রাযি. দল হতে ‘খুরুজ’ (বিদ্রোহ) করে বের হয়ে যায়। তখন হতে এ দলটি ‘খারেজী’ নামে প্রসিদ্ধ হয়। হযরত আলী রাযি. তাদের বুঝালেন- আমরা তো সালিশদ্বয় হতে এ অঙ্গীকার নিয়েছি যে, তারা আল্লাহর বিধান তথা কুরআন অনুযায়ীই ফয়সালা করবেন। তারা যদি আল্লাহর বিধান মে ফয়সালা করেন, তবেই আমরা তা মেনে নিব। নতুবা তা আমরা মানব না। তখন খারেজী দল পাল্টা প্রশ্ন করল- তাহলে আপনি কি অন্যায় ভাবে হত্যার ব্যাপারে কোন মানুষের ফয়সালা মানাকে বৈধ মনে করেন? অথচ কুরআনে তার শাস্তি নির্ধারিত আছে। হযরত আলী রাযি. উত্তর দিলেন- আমি তো কোন মানুষের ফয়সালা কখনো মেনে নেয়নি; বরং আমি কুরআনের ফয়সালাই গ্রহণ করেছি। তবে এ ফয়সালার ঘোষণা দিবেন সালিশদ্বয়। কুরআন শরীফ তো একটি কিতাব, তাতো নিজে ফয়সালা ঘোষণা করতে পারে না।
হযরত আলী রাযি. এত সব যুক্তি-তর্ক দিয়ে বুঝানোর পর বাহ্যিকভাবে মেনে নিলেও বস্তুতঃ খারেজীরা তাদের মতের ব্যাপারে অটল থাকে।
_*🗒️নিজে পড়বেন এবং শেয়ার করে অন্যদেরকেও জানার সুযোগ করে দিবেন।*_
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন