*ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস*
*====== প্রথম অধ্যায়,পর্ব -১৩ ======*
*উচ্চপদে আত্মীয়দের নিয়োগদান প্রসঙ্গে*
সরকারী চাকুরীতে স্বীয় আত্মীয় ও বংশীয় লোকদের অধিক হারে উচ্চপদ তথা গভর্ণরী প্রদানের যে অভিযোগ হযরত উসমান রাযি. এর বিরুদ্ধে করা হয়েছিল তার অসারতা প্রমাণে তার খিলাফত কালের ৪৭ জন গভর্ণরের নামের তালিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে অতিসহজেই উত্তর পাওয়া যায় যে, উক্ত ৪৭ জন গভর্ণরের মধ্যে মাত্র ৫ জন হযরত উসমান রাযি. এর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। তন্মধ্যে তিনজন ছিলেন তার নিজ বংশ তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোত্র কুরাইশের শাখা উমাইয়া গোত্রের। কিন্তু এই তিন জনের মধ্যে দুই জনই ছিলেন হযরত উমর রাযি. কর্তৃক নিয়োজিত। উক্ত পাঁচ জনের মধ্যে অপর দুই জন হযরত উসমান রাযি. এর আত্মীয় ছিলেন কিন্তু আত্মীয়তা অভিযোগের কারণ হতে পারে না। বরং হযরত উসমান রাযি. কে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করার জন্যই কেবল এ ধরনের কথা উত্থাপন করা হয়েছিল। নতুবা শুধু আত্মীয়তার খাতিরে হযরত উসমান রাযি. কাউকে গভর্নর নিয়োগ করেননি। যাকেই গভর্নর নিয়োগ করেছেন যোগ্যতাও পরামর্শের ভিত্তিতেই করেছেন। ৪৭ জন গভর্নরের ভিতরে ২/৪ জন যদি তার নিজ গোত্রের হয় এবং হযরত উসমানের রাযি. বিরাট গোত্রের মধ্যে যোগ্যতা সম্পন্ন লোক থাকাটাও স্বাভাবিক; তাহলে তাদেরকে দায়িত্বে বসালে তাতে এমন কি অপরাধ হতে পার ? বরং যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য দায়িত্বে না বসানোই অপরাধ এবং জনসাধারণের উপর জুলুম করার শামিল। কারণ বেশী যোগ্য লোক থাকতে যদি তার চেয়ে কম যোগ্য লোক দায়িত্বে বসানো হয় তাহলে নিশ্চয় জনসাধারণ ধর্মীয় সুযোগ সুবিধা ও ন্যায় বিচার কম পাবে যা অত্যন্ত স্পষ্ট। সুতরাং হযরত উসমান রাযি. এর উপর স্বজন-প্রীতির অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এটা শুধু বক্র দিল ও ট্যারা চোখ সম্পন্ন লোকদের স্বার্থবাদী অপতৎপরতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
*ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় পর্ব:*
সাবায়ীদের চাপের মুখে হযরত আলীর রাযি. খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ সাবায়ী ষড়যন্ত্রের এ পর্বকে মুসলমানদের পরস্পরে চিরস্থায়ী অনৈক্য সৃষ্টির অধ্যায় বলা চলেঃ
আব্দুল্লাহ বিন সাবার মুনাফিক দল কর্তৃক খলীফা হযরত উসমানের রাযি. শাহাদাতের পর মুসলিম জাহানের প্রথম করণীয় ছিল সর্বসম্মতিক্রমে একজন খলীফা মনোনীত করে ইসলামী খিলাফতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা এবং মুসলমানদের ঐক্যকে সুসংহত রাখা ও শরয়ী বিধান মুতাবিক হযরত উসমানের রাযি. হত্যাকারী ও বিদ্রোহীদের বিচার করা। কিন্তু সেসব যদি বাস্তবায়িত হয়ে যায় তাহলে আব্দুল্লাহ বিন সাবা ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংসের যে নীল নকশা প্রণয়ন করেছিল শুধু যে তা বিধ্বংস হয়ে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হবে তা ই নয়, বরং তখন তার ও তার দলের ভয়াবহ পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে। তাই হযরত উসমান রাযি. কে হত্যা করার পর তার সর্বপ্রথম তৎপরতা ছিল ইসলামের উন্নতির চালিকা শক্তি উম্মতের সর্বসম্মত খিলাফত ব্যবস্থা যেন আর দ্বিতীয়বার প্রতিষ্ঠা না হতে পারে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সাবায়ী দলের লোকেরা মুসলিম উম্মাহর সর্ব সম্মতিক্রমে একজনকে খলীফা বানিয়ে তার নেতৃত্বে সকলের একতাবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টাকে ঠেকিয়ে রাখার লক্ষ্যে তারা হজ্জের মওসুমে অধিকাংশ সাহাবী রাযি. ও শান্তিপ্রিয় জনগণশূণ্য দারুল খিলাফত মদীনায় যে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে হযরত উসমান রাযি. কে শহীদ করেছিল সেই পরিস্থিতিতে নিজেরাই গোটা পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে হযরত আলী রাযি. কে খলীফা পদপ্রার্থী হতে বাধ্য করে।
হযরত আলী রাযি. বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ত্বালহা রাযি. ও যুবাইর রাযি. এর নিকট খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হয়ে সাহাবা শূন্য মদীনায় যে স্বল্প সংখ্যক বিশিষ্ট সাহাবা রাযি. বিদ্যমান ছিলেন তাদের পরামর্শে ও বিধ্বস্ত খিলাফত পুনরুদ্ধারের শেষ আশায় এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে বাধ্য হয়ে সম্মতি প্রদান করেন। এর পূর্বে সাবায়ীরা মদীনাবাসীকে খলীফা নির্বাচনের জন্য তিন দিনের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে কাউকে খলীফা বানাতে ব্যর্থ হলে সকলকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত তারা দিয়েছিল। ঘটনা পরস্পরার এক পর্যায়ে তারাই হযরত আলীর রাযি. নাম প্রস্তাব করে। অতঃপর উল্লেখিত পন্থায় কতিপয় বিশিষ্ট সাহাবীর রাযি. পরামর্শে হযরত আলী রাযি. খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
হযরত আলীর রাযি. খলীফা হওয়ার পিছনে মূলতঃ সাবায়ীদের ভূমিকা থাকলেও তাঁর পক্ষে মদীনার একাধিক বিশিষ্ট সাহাবার রাযি. সমর্থনও ছিল। তাছাড়া বাস্তবিক পক্ষেও তখন হযরত আলী রাযি. খলীফা হওয়ার জন্য সর্বদিক দিয়ে যোগ্য ছিলেন। যার প্রমাণ হযরত উসমান রাযি. কে খলীফা মনোনীত করার সময় সমগ্র মুসলিম বিশ্বের রায় দু’ব্যক্তির ব্যাপারে সীমাবদ্ধ ছিল। অধিকাংশ গোত্র ও লোকের হযরত উসমানের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। অবশিষ্টরা হযরত আলীর রাযি. পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। এ দু’জন ব্যতীত অন্য কারো ব্যাপারে প্রস্তাব আসেনি। যে কারণে হযরত আলী রাযি. বিরোধী অন্যান্য সাহাবীগণ রাযি. কাউকে হযরত আলীর রাযি. বিরুদ্ধে পাল্টা খলীফা মনোনীত করেন নি। বরং তারা শুধু সাবায়ীদের ব্যাপারে বিশেষ আপত্তির কারণে হযরত আলীর রাযি. হাতে বাইয়াত হতে অস্বীকার করেছিলেন, এসকল কারণে অর্থাৎ মদীনায় অবস্থিত বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরামের সমর্থন, ও স্বীয় যোগ্যতা বলে হযরত আলীর খলীফা মনোনীত হওয়া শুদ্ধ ছিল এবং তিনি ‘খলীফায়ে বরহক’ ছিলেন। এ ব্যাপারে উম্মতের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই।
হযরত আলীর রাযি. উল্লেখিত পন্থায় খলীফা মনোনীত হওয়ার পর মদীনায় অবস্থিত যে সকল সাহাবী রাযি. তাঁর হাতে উল্লেখিত আপত্তির কারণে বাই’আত হতে অস্বীকার করেন, তাদের মধ্যে কতেককে বিশেষতঃ হযরত ত্বালহা ও যুবাইরের রাযি. ন্যায় বিশিষ্ট দুই সাহাবীকেও রাযি. সাবায়ীরা ঘাড়ের উপর তরবারী ধরে হযরত আলীর রাযি. হাতে বাই’আত হতে বাধ্য করে। খিলাফতের শূন্য পদে তাৎক্ষণিকভাবে একজনকে খলীফা বানানোতে তাদের উদ্দেশ্যে ছিল নিজেদের ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংসের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র হতে মুসলমানদের দৃষ্টি আড়াল করে রাখা, জনগণের রোষানল থেকে আত্মরক্ষা করা এবং খিলাফত ব্যবস্থায় জবরদস্তি নিজেদের সম্পৃক্ত করে নিজেরা ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ধীরে ধীরে মনোনয়নে বিভেদ সৃষ্টি করে ধাপে ধাপে খিলাফত ব্যবস্থাকে চিরতরে বিনষ্ট করে দেয়া। হযরত আলীর রাযি. মত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বকে খলীফা মনোনীত না করলে তাদের এ সকল উদ্দেশ্যে অর্জিত হতো না বরং তখন মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে কাউকে খলীফা বানিয়ে তাঁর নেতৃত্বে খলীফা হযরত উসমানের রাযি. হত্যাকারী সাবায়ীদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারতো। এ জন্য হযরত উসমান রাযি. কে শহীদ করার পর সাবায়ীদের সকল ষড়যন্ত্র মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে তা বাড়ানো ও জিইয়ে রাখার লক্ষ্যে প্রণীত হয়। সে লক্ষ্যে তারা হযরত আলী রাযি. কে খলীফা মনোনয়ন ও বিরোধীদেরকে জোর পূর্বক তাঁর হাতে বাই’আত করার উল্লেখিত পন্থা অনুসরণ করে।
মদীনার বিশিষ্ট সাহাবীগণের রাযি. সমর্থন ও স্বীয় যোগ্যতার কারণে হযরত আলী রাযি. খলীফায়ে বরহক হলেও তার মনোনয়নে হযরত উসমানের রাযি. হত্যাকারী সাবায়ী চক্রের হাত থাকা ও বিরোধীদেরকে সাবায়ী দল কর্তৃক জোর পূর্বক বাই’আত হতে বাধ্য করা এবং খিলাফতের গুরুত্বপূর্ণ পদে সাবায়ীদের জবরদস্তিমূলক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার দরুন বিপরীত মত সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়। যে কারণে আশারায়ে মুবাশশারাহ তথা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখে একই মজলিসে এই দুনিয়ায় জীবিত থেকে বেহেশতের শুভ সংবাদ লাভকারী দশজন সাহাবীর রাযি. অন্যতম দু’জন হযরত ত্বালহা ও হযরত যুবাইর রাযি. জোরপূর্বক হযরত আলীর রাযি. হাতে বাই’আত করেও তা প্রত্যাহার করে নেন এবং হযরত আয়িশা রাযি. ও হযরত মুআবিয়া রাযি.এবং উম্মুল মুমিনীনসহ বিশিষ্ট অনেক সাহাবীই রাযি. হযরত আলী রাযি. হাতে বাই’আত না হয়ে হযরত উসমানের রাযি. হত্যাকারী সাবায়ীদের হযরত আলী রাযি. কর্তৃক বিচারের দাবীতে বিরোধী শিবিরে অবস্থান গ্রহণ করেন।
*বিঃদ্রঃ*
*ভ্রান্তি নিরসনঃ* আর্টিকেল এর মধ্যে সাহাবী ও সাবায়ী শব্দ দুটি বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। তাই সাধারণ পাঠকদের মাঝে যাতে এ সম্পর্কে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয় সেজন্য শব্দ দু’টির সংজ্ঞা নিম্নে প্রদত্ত হলঃ
*সাহাবী:* যে সকল মহান ব্যক্তি ঈমান থাকা অবস্থায় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দর্শন লাভে ধন্য হয়েছেন এবং ঈমান থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
*সাবায়ী:* কুখ্যাত ইয়াহুদী আব্দুল্লাহ বিন সাবা’র অনুসারীদেরকে বলা হয় সাবায়ী।
_*📋নিজে পড়বেন এবং শেয়ার করে অন্যদেরকেও জানার সুযোগ করে দিবেন।*_
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন